খালেকদের শুকনো মুখে স্বস্তির ঝিলিক

সানাই বাজিয়ে জীবন কাটত খালেক খলিফার। বিয়েশাদি, পূজা-পার্বণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মানেই খালেক। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে থেমে গেছে এসব আয়োজন। থমকে গেছে খালেকের সানাইয়েরও সুর, কিন্তু জীবন তো থামবার নয়। পরিবারে আট সদস্যের মুখে খাবার তুলে দিতে চেনা-অচেনা অনেকের দুয়ারে ঘুরে কেটেছে অনেক মাস। ধার-দেনায় আর পেরে উঠছেন না। এ অবস্থায় হাতে পেলেন শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রের দেওয়া খাদ্যসামগ্রী, যা দিয়ে অনায়াসে চলে যাবে কয়েকটি দিন। চোখে-মুখে উচ্ছ্বাস রেখে খালেক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মরার সময় মুখে পানি পেলে মানুষের যেমন লাগে, আমারও ঠিক তেমনই লাগছে।’

আশি পেরোনো রাশেদ শেখ, ষাটোর্ধ্ব আনোয়ারা বেগম, বৃদ্ধ আবুল হোসেনদের গল্পগুলো ঘুরেফিরে একটাই। তাঁদের স্বাভাবিক জীবনে বেকারত্বের কুড়াল ঠুকেছে করোনাভাইরাস। ঘুরে দাঁড়ানোর বহু চেষ্টা বিফলে গেছে। কেউ হাত পাতছেন, কেউ অল্প আয়ে সংসারের ঘানি টানছেন। কেউ বা ধারে-দেনায় হাবুডুবু খাচ্ছেন হতাশার গহিনে। গতকাল রবিবার বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ৯১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র তাঁদের হাতে হাতে তুলে দেয় খাদ্যসামগ্রী।

সকাল থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ছিল গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায়। এর মধ্যেই শহীদ মিনার চত্বরে এসে জড়ো হতে শুরু করেন বৃদ্ধ থেকে তরুণ—অনেক শ্রেণির মানুষ। চেয়ারগুলো আগে থেকেই পাতা ছিল কিছুটা দূরত্ব মেপে। চেয়ারের সামনে তাঁদের জন্য রাখা হয় খাদ্যসামগ্রীর প্যাকেট। চাল, ডাল, তেল, আলু, লবণের প্যাকেট কাঁধে নিয়ে খোশ মেজাজেই বাড়ি ফেরেন তাঁরা।

শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র লিমিটেডের দায়িত্বশীলরা জানান, মানবিক এই আয়োজনের নেপথ্যে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন ক্লাবের চেয়ারম্যান সায়েম সোবহান আনভীর। অসহায় ও অসচ্ছল ব্যক্তিদের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণের আয়োজনে সম্পৃক্ত হন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা এবং বিভিন্ন এলাকার জনপ্রতিনিধিরা। কোটালীপাড়া পৌরসভার মেয়র হাজি মো. কামাল হোসেন শেখ আপ্লুত কণ্ঠে বলেন, ‘শেখ রাসেলের স্মৃতি ধরে রাখতে বসুন্ধরা গ্রুপ যে দায়িত্ব নিয়েছে, তা কোটালীপাড়ার মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরকে আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা পছন্দ করেন। নেত্রী যাঁকে পছন্দ করেন, আমরাও তাঁকে ইজ্জত করি।’

কোটালীপাড়া পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা রাশেদ শেখের ছয় সদস্যের সংসার। একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলে কাজ করেন লেপ-তোশকের দোকানে। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ব্যবসায় মন্দা। আবার দীর্ঘদিন ধরে দোকান বন্ধ রয়েছে। ফলে রাশেদ শেখের পরিবারে এক পর্যায়ে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। রাশেদ বাধ্য হন হাতে ভিক্ষার থালা নিয়ে রাস্তায় নামতে, কিন্তু করোনার এই দারিদ্র্যকালে পাশে পাচ্ছিলেন না কাউকেই। তিনি এবার হাতে পেলেন শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্রের খাদ্যসামগ্রী সহায়তা।

ষাটোর্ধ্ব আনোয়ারা বেগমের তিন ছেলে। একজন থাকেন রাজধানী ঢাকায়, কাজ করেন পোশাক কারখানায়। ছোট ছেলের সঙ্গে থাকেন আনোয়ারা। ছেলেটি ভ্যান চালিয়ে কোনোমতে জীবিকা নির্বাহ করতেন। করোনার কারণে এখন আর আগের মতো রোজগার নেই। আনোয়ারা এসেছেন খাদ্য সহায়তা নিতে। তিনি বলেন, ‘এই চাল-ডাল দিয়ে অনেক দিন কেটে যাবে। কয়েক দিনের জন্য মাথা থেকে টেনশন দূর হলো।’

সাকিব হোসেনের কৈশোর জীবনে নেই প্রাণচাঞ্চল্য এই অভাবেরই কারণে। সাকিব স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র। অসুস্থ বাবাকে নিয়ে তাদের সংসারে কষ্টের সীমা নেই। খাদ্য সহায়তা কাঁধে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সাকিব বলছিল, ‘দীর্ঘদিন ধরে বাবা অসুস্থ। ডাক্তার-ওষুধ করেছি অনেক দিন। এখন আর ওষুধের খরচও চালাতে পারি না। এ অবস্থায় দৈনন্দিন সাংসারিক খরচ মেটানো তো আরো কষ্টসাধ্য। খবর পেয়ে এখানে এসেছি। মনে খুব আনন্দ লাগছে।’

এভাবে কোটালীপাড়ার ছয় হাজার মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এই আনন্দ। প্রত্যেকে পেয়েছে ১০ কেজি চাল, দুই কেজি আলু, দুই লিটার সয়াবিন তেল এবং এক কেজি করে ডাল ও লবণ। শুধু তা-ই নয়, উপজেলার এক হাজার শিক্ষার্থীর জন্য দেওয়া হয়েছে শিক্ষা উপকরণ। দৃষ্টিনন্দন স্কুলব্যাগের সঙ্গে ছিল ছয়টি খাতা, একটি করে পেনসিল বক্স, কলম, পেনসিল, শার্পনার, ইরেজার ও স্কেল।

ঘাঘর নদীর তীরে কোটালীপাড়ার এই আনন্দ ছড়িয়ে গেছে মধুমতীর তীরেও। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায়ও দুই হাজার পরিবারে দেওয়া হয়েছে খাদ্যসামগ্রী। এক হাজার শিক্ষার্থীর জন্য দেওয়া হয় শিক্ষা উপকরণ।

Source: Kaler Kantho

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published.